রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০১:৫৩ পূর্বাহ্ন
মোস্তফা কামাল:
দলগত কু-দশা হলেও ব্যক্তিগতভাবে তারা কামিয়াবি। দেবর-ভাবীসহ জনাকয়েকের আম-ছালা সবই থাকছে। আবার হারালেও মালুমের বোধ নেই। যেমন ন্যাংটার থাকে না ইজ্জতের ভয়। বিরোধী দল হওয়ার দৌড়ে তারা কামিয়াবি হয়েছে, আপাতত এটাই বিশাল জয়। সরকার নানাদিক হিসাব করে স্বতন্ত্রদের জোটকে সংসদে বিরোধী দল হওয়ার সুযোগ দেয়নি। চান্সটা জাতীয় পার্টিকেই দিয়েছে। জাতীয় পার্টি আবারও ভাঙল, কি জোড়া লাগল সেটা সরকারের দেখার বিষয় নয়। তবে সর্বজনীনভাবে বিনোদনের বিষয়। নির্বাচন-আন্দোলন-রাজনীতি-অর্থনীতিসহ বিভিন্ন সেক্টরে নানা ছিদ্দতের মধ্যে বিনোদনের জোগানটা একমাত্র এই দলটিই দিচ্ছে। বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কার বা অব্যাহতিতেও দিচ্ছেন বাড়তি বিনোদন। তা ভাঙতে ভাঙতে দল পাঁচ-ছয় টুকরা করে হলেও।
সাময়িক বিরতি দিয়ে দেবর-ভাবীর পিঠাভাগ হয়েছে আবারও। তাদের একান্তদের তাতে লোকসান নেই। কোনো এক ব্রেকফার্স্ট বা লাঞ্চে ভাগ আরেকরকম হবে। এতে তাদের লাজ-শরম যাবে না। দুর্গতি হয় শুধু ভুল ট্রেনে উঠে পড়া কিছু কর্মীর। পরে কোনো স্টেশনও নেই যেখানে তারা নেমে পড়তে পারে। এতে ট্রেন যত দূরে যায় তাদের ফেরার কষ্ট কেবল বাড়ে। এবার পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়ে রওশন এরশাদের নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণার সার্কাসটাও বেশ ইন্টারেস্টিং। ২৮ জানুয়ারি রবিবার দিনের মধ্যভাগে গুলশানের বাসায় কাদের-চুন্নুকে অব্যাহতির ঘোষণা দেন পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পত্নী দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। মহাসচিব করেছেন জাপার বহিষ্কৃত প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনুর রশীদকে। দলের পরবর্তী কাউন্সিলের আগ পর্যন্ত এই মহাসচিব দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন বলে জানান রওশন এরশাদ। সংবাদ সম্মেলন নয়, মতবিনিময় সভার নামে আসে ঘোষণাটি। পুত্র সাদ এরশাদকে পাশে নিয়ে সভাটি হয় রওশন এরশাদের গুলশান বাসভবনের নিচে। এতে জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত, অব্যাহতিপ্রাপ্ত, স্বেচ্ছায় পদত্যাগকারী নেতাকর্মীরা অংশ নেন। উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টি থেকে অব্যাহতি পাওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, সাবেক উপমন্ত্রী গোলাম সারওয়ার মিলন, সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য দেলোয়ার হোসেন খান, জিয়াউল হক মৃধাসহ অনেকে। আরেক বহিস্কৃত কাজী ফিরোজ রশীদকে দেখা যায়নি।
দেবর জিএম কাদের এবং এক সময়ের পরম স্নেহের চুন্নুকে অব্যাহতি দেওয়ার কারণ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্য, পার্টিকে কেনাবেচাসহ হাফডজন অভিযোগ করেন রওশন এরশাদ। তার ভাষায় : দলের গঠনতন্ত্রের ২০-এর ১ ধারা অনুযায়ী জিএম কাদের ও মো. মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি প্রদান করলাম। জাতীয় পার্টির ক্ষতি মেনে নিতে পারছেন না জানিয়ে বলেছেন, পার্টি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এর কিছুক্ষণ পর বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এমপি। রওশন এরশাদের ঘোষণা আমলে নেওয়া হচ্ছে না বলে জানান তিনি। বলেন, গঠনতন্ত্রে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে এমন কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তাই রওশনের ঘোষণার কোনো ভিত্তি নেই। গঠনতন্ত্রে রওশন এরশাদের এ ধরনের কোনো ক্ষমতাই নেই।
গঠনতন্ত্রের ২০-এর ১ ধারাটি জাতীয় পার্টিতে ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। দেবর-ভাবী কেন, স্বামী-স্ত্রী, ভাইয়ে-ভাইয়েও এ ধারা প্রয়োগ হয়েছে। এরশাদ তার জীবদ্দশায় এ ধারায় স্ত্রী রওশন এবং ভাই কাদেরকে একাধিকবার অব্যাহতি দিয়েছেন। আবার ভাবী রওশনও এর আগে জিএম কাদেরকে অন্তত দুবার বহিষ্কার করেছেন। এবারেরটা তৃতীয়। পরে আবার ঘোষণা প্রত্যাহারও করেছেন। যে যখন এ ধারায় আক্রান্ত হন তখন বলেন, এটার কোনো ভিত্তি নেই। এখন চুন্নুও বলছেন। তবে, একটু অন্যভাবে। চুন্নু-কাদেররা যাদের বহিষ্কার করেছেন তাদের কথাও এমনই। তবে, তাদের বিভিন্ন বক্তব্য প্রসঙ্গে চুন্নু বলেন, তাদের কথা একদম অবান্তর। আর কাদের-চুন্নুকে বহিষ্কার করা অশিক্ষিত মানুষের মতো কাজ। রওশন এরশাদের বিরুদ্ধে দলীয় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে চুন্নু বলেন, রওশন এরশাদ আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের স্ত্রী। ওনাকে আমরা শ্রদ্ধা করি। সেই শ্রদ্ধার কারণে ওনাকে পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়। এটা আলংকারিক পদ। কাজেই আলংকারিক পদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। রওশনপন্থিদের দলের লোকই মনে করেন না বলে জানিয়েছেন চুন্নু। রওশনপন্থিরা কাউন্সিল করবেন ও কাকরাইলের অফিসে বসবেন এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, তাদের এই অধিকার নেই। দলের প্রেসিডিয়াম ও নির্বাহী কমিটি তার ও জিএম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বলেও দাবি তার।
পার্টির অভ্যন্তরে এই নাটকীয়তার দিনই জিএম কাদেরকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় সংসদ সচিবালয়। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে দেওয়া হয়েছে বিরোধী দলের উপনেতার স্বীকৃতি। এদিন সন্ধ্যায়ই গণভবনে ডেকে নেওয়া হয়েছে স্বতন্ত্র ৬২ এমপিকে। তারা ধন্য প্রধানমন্ত্রী ডেকেছেন বলে। আর জাতীয় পার্টি ধন্য বিরোধী দল হওয়ার দৌড়ে কামিয়াবি হয়ে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২৩টি আসন। স্বতন্ত্ররা ৬২। আর জাতীয় পার্টির ‘ওরা ১১ জন’। তিনটি আসন পেয়েছে অন্য তিনটি দল। একটি আসনে নির্বাচন এখনো বাকি আছে।
জাতীয় পার্টির সামনে আরও কিছু নির্বাচনী কর্মযজ্ঞ তথা মনোনয়ন বাণিজ্য আছে। সেটি হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রের শূন্যপদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের বেশ ক’টিতে সাধারণ ও উপনির্বাচন আগামী ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। এগুলোর জন্য ১ ফেব্রুয়ারি থেকে মনোনয়ন ফরম বিতরণ করবে জাতীয় পার্টি। এরপর উপজেলা নির্বাচন। এটি জাতীয় পার্টির জন্য স্পর্শকাতর। এরশাদ উপজেলা পদ্ধতির জন্ম দিয়েছেন। সামনের উপজেলা নির্বাচনে তাদের কিছু ছাড় দেওয়ার সরকারি অফার আছে বলে প্রচারণা আছে। জাতীয় নির্বাচনের পর হতে যাওয়ায় স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে একটি বাড়তি ক্রেজ থাকাই স্বাভাবিক। সেগুলোতেও লড়াইটা আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগেই হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট। ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের বড় অংশ ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে সরকারের প্রতি অসন্তোষ জানানোর ধারাবাহিকতা উপজেলায়ও থাকবে। এবার উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে নৌকা প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের। কেবল আগের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নয়; আরও অনেক কিছু ভেবেচিন্তেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে।
সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে কিছুটা বেকায়দায় বা ‘ট্র্যাপে’ ফেলার পরিকল্পনাও আছে এ নির্বাচনটির মাধ্যমে। বিএনপির স্থানীয় বাছাইকৃত প্রভাবশালী নেতাদের এ নির্বাচনে আনার একটি চিন্তা ঘুরছে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে। এর সুবাদে জাপার ভাগ্যে কিছু তোহফা বা নজরানা মিলতেও পারে। আওয়ামী লীগের বোঝাপড়ার মিত্র জাতীয় পার্টি সেই আশায় উদগ্রীব। দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তে দলীয় মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ এবং টাকা-পয়সা কম খরচের আশায় জাপার স্থানীয়, এমনকি কেন্দ্রীয় নেতাদের কারও কারও মধ্যেও হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। এর আগে উপজেলা নির্বাচন হয়েছে ২০১৯ সালে। এতে ৪৭৩ উপজেলার মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থীরা ৩২০টিতে চেয়ারম্যান পদে জিতেছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ১১৫ জন। আর স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান হন ১৩৬ জন। যার প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের। জাতীয় পার্টি এখন সেখানে মাথা ঢুকিয়ে কিছু প্রাপ্তি যোগ করতে চায়। কতটুকু সফল হবে, সেটা ভবিষ্যতের বিষয়। তবে, আলোচনা ও সার্কাস বা বিনোদনের খোরাক জোগানোর সক্ষমতা তাদের আছে। সেই পারঙ্গমতা অবিরাম দেখিয়ে আসছে জাতীয় পার্টি। কেবল নেতা নন, দলটির বহুধাবিভক্ত কর্মীরাও এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত তালিমপ্রাপ্ত।
ক্ষেত্রবিশেষে নেতাদের চেয়েও বেশি দক্ষতাসম্পন্ন তাদের কর্মীরা। কাউকে মাথায় তুলতে বা পায়ে নামাতে একটুও সময় লাগে না তাদের। রবিবার রওশন এরশাদের কাদের-চুন্নকে বহিষ্কার ঘোষণার আগ মুহূর্তের মতবিনিময়ে সভায় কয়েক নেতার বক্তব্যের মধ্যেও ছিল সেই দক্ষতার ছাপ। জাপা থেকে অব্যাহতি পাওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম রওশন এরশাদের উদ্দেশে বলেন, ‘দলের মধ্যে আবর্জনা পরিষ্কার আপনার নেতৃত্বে করতে চাই। আপনি জাপার হাল ধরবেন। জিএম কাদের ও চুন্নুকে দেশের নেতাকর্মীরা নেতৃত্বে দেখতে চায় না। আজ থেকে আপনাকে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে চাই।’ ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বাড়ির দারোয়ানরা এখন মালিক হতে চায়। এ সংকটে আপনাকে আবার এগিয়ে আসতে হবে।’ প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় বলেন, দলের মধ্যে বর্গির হানা পড়েছে। আবার আপনাকে দায়িত্ব নিয়ে দল রক্ষা করতে হবে। এ ধরনের বক্তব্য রাখা নেতারা মাত্র কিছুদিন আগেও কাদের-চুন্নুর পক্ষে হেন কথা নেই যা না বলেছেন। আবার রওশন এরশাদই বা কোনো একদিন সকাল বা সন্ধ্যায় কার পক্ষে-বিপক্ষে কী করেন বা বলে বসেন তাও দেখার বিষয়। কখন আবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোনো আবদার নিয়ে ছুটে যান সেই অপেক্ষাও আছে কারও কারও।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
mostofa71@gmail.com
ভয়েস/আআ